বিপর্যস্ত সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা :
---- মুহাম্মাদ বশির উল্লাহ
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ তা\'আলার এবং আমাদের প্রিয় রসূল (সাঃ) এর প্রতি দরুদ ও সালাম।
মহান আল্লাহ তা\\\'য়ালা বলেন:
يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ (276)
আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং সাদকাহ বা দান খয়রাতকে বৃদ্ধি করেন। আর আল্লাহ তা\\\'আলা কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে পছন্দ করেন না।- সূরা বাক্বারা -২৭৬।
বর্তমান আমাদের সমাজে একদিকে গরীব দুঃখী ও অবর্ণনীয় দুরাবস্থার শিকার ভূখা-নাঙা মানুষ যাদের হাতে মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ নেই; অপরদিকে তাদেরই পাশাপাশি রয়েছে স্বার্থপর, বিলাসপ্রিয় দাম্ভিক কারুনের মত অঢেল বিত্তশালী মানুষ যারা কোথায় খরচ করবে তার স্থান খুঁজে পাচ্ছে না। আজ বিশ্বের মোট সম্পদের ৯৯% সম্পদ ১% লোকের হাতে কুক্ষিগত। আজকে আমাদের এ বাংলাদেশের মত ছোট্ট একটি দেশে ২৮০০০ কোটিপতি। সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার ফলে ধনী-গরীব বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌছেছে। বর্তমানে এ অর্থব্যবস্থা যে বিপর্যস্ত তার কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হল।
বিপর্যস্তবিশ্ব অর্থব্যবস্থা:
১। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট-আন্দোলন মানে পুঁজিবাদের কেন্দ্রস্থল নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিট দখল আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব জুড়ে ৫ জুন বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন ------------------।
২। পুঁজিবাদের ধারক বাহক যুক্তরাষ্ট্রে গত দুই বছরে ২৩৭ টি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে।- দৈনিক যায় যায় দিন ২৯/০১/১২
৩। বিশ্ব অর্থনীতি এখন বিপজ্জনক গভীরে নিপতিত।-২৪ জানুয়ারী IMF প্রধানের বক্তব্য- দৈনিক বনিক বার্তা-৩১/০১/১২
৪। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য :
জানুয়ারী ২০১১-মূদ্রস্ফীতি ১১.৫৯ শতাংশ
পরিবার প্রতি গড় আয়-১১,৪৮০/= টাকা
\" \" \" ব্যয় ১১,২০০/= টাকা
৫। পুঁজিবাদী অর্থনীতির দিন শেষ\\\"-নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মাদ ইউনুছ-২৪/১২/২০১১ চট্টগ্রাম সম্মেলন।
৬। গ্রীস, ইতালী, ফ্রান্সসহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশ দেউলিয়া হওয়ার পথে, IMF এবং World Bank কোন রকম Life Support দিয়ে দেউলিয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
৭। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ শেয়ার বাজার ধ্বস।
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার প্রবর্তনকারী দেশের অর্থনীতিবিদগণের ঘুম হারাম হয়ে গেছে বিপর্যস্ত অর্থনীতি থেকে উত্তরণের জন্য। তাঁরা নিজেদের অজ্ঞতা ও মূর্খতার দরম্নণ কখনো সমাজতন্ত্র তথা কম্যুনিজমের শরণাপন্ন হন, আবার কখনো বা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করেন। সমাজতন্ত্র যদিও সার্বিক কল্যাণ ও সমৃদ্ধির বার্তাবাহক হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। কিন্তু একদিকে সে মহান আল্লাহ তা\\\'আলার বিদ্রোহী সেজে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অপরদিকে নিজেকে শ্রেণী সংগ্রামে জড়িয়ে ফেলেছে। ফলে দেখা গেছে, বিশ্বজনীন শান্তি বার্তার পরিবর্তে সমাজতন্ত্রও একটি বিশেষ শ্রেণীর শাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতি হওয়ার ফলে এটি বহু আগেই আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা ধ্বংস/ বিপর্যস্ত হওয়ার মৌলিক কারণ ও বিকল্প অর্থব্যবস্থা অনুসন্ধান:
প্রত্যেকটি মানুষ অর্থনৈতিক লেনদেনের সাথে জড়িত। যে নীতি বা ব্যবস্থা মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে তাকে অর্থব্যবস্থা বলে। ৩টি মৌলিক অথনৈতিক সমস্যা:
ক. কি কি দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করা হবে?
মদ উৎপাদন করা হবে; না গরম্নর খামারে দুধ উৎপাদন করা হবে? বিলাসদ্রব্য উৎপাদন করা হবে; না প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্য উৎপাদন করা হবে? রস দিয়ে তারি তৈরী করা হবে; না গুড় তৈরী করা হবে? মহিলাদের জন্য জিন্স প্যাণ্ট ও ফতুয়া তৈরী করা হবে; না বোরখা ও পর্দার উপকরণ তৈরী করা হবে ?
খ) কিভাবে উৎপাদন করা হবে?
বৈধ ভাবে উৎপাদন করা হবে; না ভেজাল মিশিয়ে উৎপাদন করা হবে? শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করে উৎপাদন করা হবে; না শ্রমিকদরে রক্ত চুষে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে উৎপাদন করা হবে? ইত্যাদি।
গ) কাদের জন্য এসব পণ্য সামগ্রী ও সেবা উৎপাদন করা হবে?
গরীবদের জন্য উৎপাদন করা হবে; না ধনীদের জন্য উৎপাদন করা হবে? শহরের লোকদের জন্য উৎপাদন করা হবে; না গ্রামের লোকদের জন্য উৎপাদন করা হবে?
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা উপরোক্ত সমস্যার সমাধান হিসেবে একমাত্র market mechanism তথা পণ্যদ্রব্যের চাহিদা ও যোগান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন, নৈতিকতার কোন প্রশ্ন করা হয় না।
পারস্পারিক পর্যালোচনা
১। অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তি:
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ধরেই নেয়া হয়েছে মানুষের অভাব অসীম অর্থাৎ চাহিদা অসীম এবং তা পূরণের জন্য যে সম্পদ রয়েছে তা সীমিত অর্থাৎ যোগান সীমিত। সীমিত সম্পদ দ্বারা অসীম অভাব পূরণ করার অব্যর্থ চেষ্টা করাই সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূল আলোচ্য বিষয়। কিন্তু বাস্তবে কখনোই সীমিত সম্পদ দ্বারা অসীম অভাব পূরণ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় অর্থনেতিক সমস্যা কখনোই সমাধান হবে না এটাই বাস্তবতা। যার বাস্তবতা আজ বিশ্ববাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার জনক এ্যাডাম স্মিথ বলেন,\\\" মানুষ খুব Greedy (লোভী) তাই তাকে স্বাধীন ছেড়ে দাও লোভের কারনে কাজ করবে এবং অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হবে\\\"
পক্ষান্তরে ইসলামী অর্থব্যবস্থার কাজ হল মানুষের ভিতর থেকে Greedy (লোভ) বের করা এবং Need পূরণ করা। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় অভাবের স্থলে প্রয়োজন শব্দ ব্যবহার করা হয়। মানুষের প্রয়োজন সীমিত এবং প্রয়োজন পূরণের জন্য সম্পদ পর্যাপ্ত। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সূরা হিজরের ১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা\\\'আলা বলেন,
وَالْأَرْضَ مَدَدْنَاهَا وَأَلْقَيْنَا فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْبَتْنَا فِيهَا مِنْ كُلِّ شَيْءٍ مَوْزُونٍ (19)
\"আমি ভূপৃষ্টকে বিস্তৃত করেছি এবং তার উপর পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে প্রত্যেক বস্তু সুপরিমিতভাবে উৎপাদন করেছি।\\\"
অতএব, সুপরিমিত বা পর্যাপ্ত সম্পদ দ্বারা সীমিত প্রয়োজন মিটানো সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হয় একদিকে সম্পদের পরিপূর্ণ, উপযুক্ত, কার্যকর ব্যবহারের অভাব ও সমাজ ও ব্যক্তির উদ্যোগের অভাব অন্যদিকে মানুষের লাগামহীন চাহিদা।
এই লাগামহীন চাহিদাকে/প্রয়োজনকে পবিত্র কুরআনে এভাবে টেনে ধরেছেন-
وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا (26) إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا (27)
আত্মীয় স্বজনকে তার হক দান কর এবং অভাব গ্রস্থ ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অকৃতজ্ঞ। (বনী ইসরাইল-২৬-২৭)
অন্যত্র মহান আল্লাহ তা\\\'আলা ইরশাদ করেন-
أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ (1) حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ (2)
প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে গাফেল রাখে। এমনকি তোমরা কবরস্থানে পৌছে যাও।(সূরা তাকাসূর ০১-০২)
পুঁজিবাদী অর্থনীতির চাহিদা সম্পর্কে একটু ধারনা নেয়া দরকার বোধ করছি।
নিম্নের ৩টি শর্ত পূরণ করলে তাকে চাহিদা বলে।
(১) দ্রব্য ও সেবা ক্রয়ের প্রতি ক্রেতার প্রবল আকাঙ্খা।
(২) ক্রয় করার আর্থিক সামর্থ্য।
(৩) অর্থ ব্যয় করার ইচ্ছা।
উপর্যুক্ত চাহিদার সংজ্ঞায় আর্থিক সামর্থহীন শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, নারী, মুসাফির, এতিম, মিসকীন ও অভাবীদের অর্থব্যবস্থার আলোচনায় শুরুতেই বাদ দেয়া হয়েছে। তাই এই অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে কখনোই সার্বিক মানবকল্যাণ সাধন সম্ভব নয়।
পক্ষান্ত্মরে ইসলামী অর্থনীতিতে যাকাত, ওশর সদকাতুল ফেতর, নফল সাদকাহ্ প্রভৃতির মাধ্যমে উল্লেখিত ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা রয়েছে।
২। সম্পত্তির মালিকানাঃ
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত। এর অন্তর্র্নিহিত অনুমিতি হল সম্পত্তিতে মানুষের মালিকানা নিরংকুশ, যার তাৎপর্য হল সে তার সম্পত্তি যেভাবে খুশি ব্যবহারের বৈধ অধিকারী। এমনকি অপব্যহার, অপচয় ও নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারে।
পক্ষান্ত্মরে ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পত্তির মালিক একমাত্র আল্লাহ তা\\\'আলা এবং তা ব্যয় ও ব্যবহার একমাত্র আল্লাহ তা\\\'আলার নির্দেশিত নিয়মানুযায়ী হতে হবে।
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা\\\'আলা বলেন,
لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللَّهُ فَيَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (284)
যা কিছু আকাশ সমূহে রয়েছে এবং যা কিছু জমীনে আছে, সব আল্লাহরই। যদি তোমারা মনের কথা প্রকাশ করো কিংবা গোপন কর, আলস্নাহ্ তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নিবেন। অতঃপর যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন। এবং যাকে ইচ্ছা তিনি শাস্তি দিবেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান।-(সূরা বাক্বারা -২৮৪)
আর মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে আল্লাহর সম্পদ ব্যবহারকারী মাত্র। এজন্য ইসলামী অর্থব্যবস্থায় মানুষ সমাজের দারিদ্র ও অভাবী শ্রেণীকে উপেক্ষা করে কোন কিছু ভোগের ক্ষমতা রাখে না। অপব্যয়, অপব্যবহার বা শোষনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে।
রাসূল স. বলেন,: প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে যে ব্যক্তি রাত্রিযাপন করে সে আমার উম্মত নয়।
মালিকানা যেহেতু আল্লাহর, সেজন্যই সম্পদের যাকাত, ওশর, সাদকাহ অর্থব্যয় করে হজ্জ্ব করার হুকুম করা হয়েছে।
৩। সম্পদ উৎপাদন ও বণ্টন:
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনকারীর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। তারা মার্কেট মেকানিজম দ্বারা তাড়িত হয়ে মুনাফা সর্বোচ্চ করণের লক্ষ্যে যেকোন পণ্য যেকোন পরিমান উৎপাদন এবং যে কোন ভাবে বণ্টন করার অধিকার রাখে। উদাহরণ স্বরুপ বর্তমান ব্যয় বহুল অশ্লীল বিজ্ঞাপণ।
পক্ষান্তরে ইসলামী অর্থব্যবস্থায় মদ, মাদক দ্রব্য, জুয়া, সকল নৈতিকতা বিনাশী উপকরণ, ব্যপক গণবিধ্বংসী সমরাস্ত্র, সৃষ্ট জীবের জন্য ক্ষতিকারক এমন কোন পণ্য দ্রব্য উৎপাদন করা যাবে না। এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৪. ভোগঃ
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনকারীর মত ভোক্তার সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত। উপযোগ সর্ব্বোচ্চকরণের লক্ষ্যে সমাজের স্বার্থের প্রতি তোয়াক্কা না করে যে কোন সামগ্রী যে কোন পরিমান ভোগের স্বাধীনতা তাদের রয়েছে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবীদ লর্ড কিন্সের মতে, \\\"ভোগ আয়েরই একটি অপেক্ষক।\\\"
ইসলামী অর্থনীতিতে ভোক্তার পছন্দ নৈতিকতা, আদর্শ ও আধ্যাত্মিকতা দ্বারা পরিচালিত। এক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের দিক নির্দেশনা হল-
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا (29)
তুমি একেবারে ব্যয় কুন্ঠ হয়োনা এবং একেবারে মুক্ত হস্ত্ম ও হয়োনা। তাহলে তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে। (বনী ইসরাইল-২৯)
৫. জবাবদিহিতা:
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সম্পদ বন্টন, ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিকট জবাবদিহিতার তেমন কোন কথা বলা হয়নি। কিন্তু ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় দ্বৈত জবাবদিহিতার কথা বলা হয়েছে,
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ
\\\"আল্লাহ তোমাদেরকে যা দান করেছেন তদ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেও না এবং মানুষের প্রতি দয়াশীল হও যেভাবে আল্লাহ তোমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন\\\"
(আল-ক্বাসাস: ৭৭)
৬। সুদ:
উৎপাদনের উপকরণ হলো ভুমি, শ্রম, মূলধন ও উদ্যোক্তা। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মূলধনের ভাড়া হিসেবে সুদ ধার্য করে। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় বলা হয়, পুঁজির কোন ভাড়া হয় না। ভাড়া হয় ঐ জিনিসের যার থেকে উপকার বা সেবা পেতে হলে এর অস্তিত্ব অটুট থাকে এবং কোন আসমানী বিপদে ধ্বংস হলে মূল মালিকেরই ক্ষতির ঝুঁকি বহন করতে হয়। কিন্তু পুঁজির ক্ষেত্রে তা কার্যকর নয়। এর থেকে সেবা পেতে হলে উহা ব্যয় করা ছাড়া সম্ভব নয়।
রাসূল (সঃ) বলেন, \\\"আপাত দৃষ্টিতে যদিও সুদের দ্বারা সম্পদ বাড়ে কিন্তু সুদের শেষ পরিণতি স্বল্পের দিকে। (মুসনদে আহমাদ)
যে কোন উৎপাদন ধর্মী কাজ কারবারে উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হল কারবারের সাথে জড়িত ব্যক্তিগণ উক্ত ব্যবসার প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং এর উন্নতি ও অগ্রগতি কামনায় আন্তরিক হওয়া ও উক্ত কারবারের ক্ষয়ক্ষতিকে নিজের ক্ষয়ক্ষতি মনে করা। সাথে সাথে উক্ত কারবারের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য যেকোন ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসা।
অনুরূপভাবে উক্ত কারবারের উন্নতিকে নিজের উন্নতি মনে করা এবং উন্নতি ও অগ্রগতি সাধনার্থে সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু সুদী অর্থব্যবস্থায় ঋণদাতা ঋণ দেয়ার পর অপেক্ষা করতে থাকে নির্দিষ্ট দিনের জন্য। নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে ঋণকৃত অর্থ সূদসহ পরিশোধ না করতে পারলে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ ধার্য করার ফলে অনেক সময় ঋণ গ্রহিতা ঋণ খেলাপি হয়ে যায়। কারণ ঋণ গ্রহিতা অধিকাংশ সময়ই ফান্ড ডাইভার্ট করে অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করার অপপ্রয়াস চালায়। এই অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের ফলেই আমেরিকায় ২৩৭ ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে প্রকৃতপক্ষে যে পণ্য ও সেবা অর্থনীতিতে ছিল তার তুলনায় ঋনের পরিমান ছিল ১২ গুন।
আর ইসলামী অর্থব্যবস্থায় মুশারাকা বা মুদারাবা ভিত্তিক বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারীর চিন্তা থাকে কোম্পানীর সফলতা যেন বৃদ্ধি পায়, তাহলে বিনিয়োগকারীরই লাভ। বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তার যৌথ মনোযোগ ও আন্তরিকতার ফলশ্রুতিতে কোম্পানীর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলে কোম্পানীর মুনাফা বাড়ে, মুনাফা বাড়লে শ্রমিক-কর্মচারীর আয় বাড়ে, শ্রমিক কর্মচারীর আয় বাড়লে ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে, ক্রয় ক্ষমতা বাড়লে কোম্পানীর বিক্রয় বাড়বে, কোম্পানীর বিক্রয় বাড়লে আয় ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়ে গোটা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল হবে। অতএব, সুদী লেনদেন কেবল জুলুমই নয়, বরং সামাজিক জীবনে এটা এক মহা বিপর্যয়। যে সম্প্রদায় উৎপাদনের শীর্ষকর্তা, যাদের শ্রমের বদৌলতে সম্পদ উৎপাদিত হয়, সামগ্রিক উন্নতি ও অগ্রগতি যাদের উপর নির্ভরশীল, তাদের উপর জোঁকের ন্যায় রক্ত চুষোক, নিষ্ঠুরতম বিত্তবান লোকদেরকে লেলিয়ে দিয়ে নিরীহ মানুষের রক্ত চুষে চুষে ক্রমান্বয়ে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার মাধ্যমে সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে সমস্ত্ম সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে।
শোষণের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ
এক সময় সুদের ব্যবসায় মহাজনী প্রথা প্রচলিত ছিল। এখন মহাজনী প্রথা ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুদের রমরমা ব্যবসা প্রসারিত হয়েছে।
দুটি মৌলিক মার্কেট হলঃ
i) Money Market
ii) Capital Market
i) Money Market-এর প্রতিষ্ঠান হল ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যাংক যে প্রধান কাজ করে তাহলো সাধারণ জনগণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় পুঞ্জিভূত করে বড় বড় শিল্পপতিকে ঋণ দিয়ে থাকে। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় এমন হয় যে, কোন শিল্পপতি ১০ লক্ষ টাকা নিজের ও ৯০ লক্ষ টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরম্ন করল। মনেকরি ৫০% লাভ হল এবং লাভ সহ পুঁজি দাঁড়ায় দেড়কোটি। সে সর্ব্বোচ ১৫ লক্ষ টাকা সুদ হিসেবে ব্যাংককে দেয়। অপরদিকে তার মূলধন দাঁড়াল (১০+৩৫)=৪৫ লক্ষ টাকা। এ দিকে ব্যাংক যে ১৫ লক্ষ টাকা পেল তা থেকে ৫ লক্ষ টাকা নিজস্ব খরচ ও লাভ বাবদ রেখে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমানত কারীদের বন্টন করে। আমানতকারীগণ ৯০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ১১% সুদ বাবদ পেল। অথচ বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার ১১.৫৯%। এরপরও উদ্যোক্তা ব্যাংককে দেয় ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ের মধ্যে ধরে নেয়। ফলশ্রম্নতিতে দ্রব্যের মূল্যের মধ্যে অন্তুর্ভূক্ত হয়ে শেষ পর্যায়ে ইহাও সাধারণ মানুষের পকেট থেকে যায়।
যদি কারবারে কোন আসমানী বিপদ বা দূর্ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হলে ঋণগ্রহীতা ইন্সুরেন্স কোম্পানীর মাধ্যমে সে ক্ষতি পূরণ করে নেয়। সে ইন্সুরেন্স কোম্পানীতেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের প্রিমিয়ামের অর্থ জমা করা হয়।
অপরদিকে পুঁজিপতি বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হলে ব্যাংককে ঋণ পরিশোধ ব্যর্থ হলে অর্থাৎ দেউলিয়া হলে একজন ব্যক্তি যতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ হল তার চেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী। সার কথা হল বর্তমান ব্যাংকিং পদ্ধতিতে সুদী নীতির কারণে পুরো জাতীর পুঁজি কয়েকজন বড় পুঁজিপতির উপকারে ব্যবহৃত হয়
কিন্তু উক্ত বিনিয়োগ যদি শিরকত বা মুদারাবার ভিত্তিতে হয় এবং উভয়ের মাঝে লাভ-লোকসানের হার যদি ৭০: ৩০ নির্ধারণ হয় তাহলে ৫০ লক্ষ টাকা লাভ হলে ব্যাংক কমপক্ষে ৩৫ লক্ষ টাকা পাবে। এ দিকে ব্যাংক যে ৩৫ লক্ষ টাকা পেল তা থেকে ৫ লক্ষ টাকা নিজস্ব খরচ ও লাভ বাবদ রেখে ৩০ লক্ষ টাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমানত কারীদের বন্টন করে অর্থাৎ আমানতকারীগণ ৯০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ৩৩% মুনাফা বাবদ পাবে। ব্যংককে ফেরত দেয়া অর্থ যেহেতু পন্য বিক্রয়ের পরই নির্ধারিত হয় তাই উহাকে উৎপাদন খরচে হিসেব করে সাধারণ জনগণের পকেট থেকে উসূল করা হয় না। ফলশ্রম্নতিতে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা বৃহৎ অংশ মুনাফা হিসেবে পেয়ে থাকে। এবং অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে বাজার থেকে উৎপাদিত পণ্য জনগন ক্রয় করতে পারবে।
আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীগন যদি ব্যংক থেকে ঋণ নিতে চান তাহলে তাদেরকে শুধু Unproductive খাতে যেমন Household ও বিলাসদ্রব্য ক্রয়ের জন্য অল্প পরিমান ঋণ দেয়া হয় যার সুদের হার সর্বোচ্চ এবং তার সামান্য আয় থেকে মাসিক কিস্তি পরিশোধ করতে করতে হয়রান হওয়া ছাড়া গত্যান্তর নেই।
এছাড়াও NGO, Financial Institution, MLM এবং Multipurpose কো-অপারেটিভ সোসাইটি গুলোর বিভিন্ন System এর মারপ্যাচে অথবা ব্যবসার খাতিরে শরীয়াহ্ শব্দ ব্যবহার করে সুদের ব্যবসা করছে।
ii) Capital Market:
কোম্পানীর মালিকগণ ব্যাংক ঋণ ছাড়াও Stock Market থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়ে বছরের পর বছর Dividend ঘোষণা না করে ও ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে। যেমন: Z ক্যাটাগরির কোম্পানী। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীগণ কোম্পানীর সম্পদ, ব্যবসায়িক সফলতা-ব্যর্থতা, লভ্যাংশ প্রদান ইত্যাদির খোঁজ খবর না নিয়ে বিনিয়োগ করে থাকে। দু\\\'একটি শেয়ারের দাম যখন বাড়তে থাকে তখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হাতের শেয়ার বিক্রি করে না। শুধু কিনতে থাকে। তারা ভাবে যে দাম তো বাড়ছে, আরো বাড়বে, দেখিনা কোন পর্যন্ত্ম যায়। দেখতে দেখতে একসময় দাম কমতে থাকে। সে তখন ভাবে এখন বিক্রি করলে তো লোকসান হবে। তাই পুনরায় দাম বাড়ার অপেক্ষা করে। পিছনে কোন কারসাজি থাকলে দাম আর বাড়ে না, কমতেই থাকে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীগণ ক্ষতিগ্রস্থ ও নিঃস্ব হয়। এর পিছনে মূলত লোভই কাজ করে বেশী। অর্থাৎ এর বৈশিষ্ট্য অনেকটা জুয়ার মত। এছাড়াও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বন্ধক রেখে নির্দিষ্ট হারে সুদের বিনিময়ে ঋণ দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্থ হলেও মার্চেন্ট ব্যাংক কোন ক্ষতি বহন করে না।
সুদের কুফল:
১। সুদখোর ব্যক্তির বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সঃ) যুদ্ধ ঘোষণা করেছেনঃ
আল্লাহ তা\\\'য়ালা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (278) فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ (279)
\"হে ঈমানদারগণ! তোমারা আল্লাহ কে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। অতঃপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তাওবাহ কর তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে।\\\"
-(আল বাকারাহ ২৭৮-২৭৯)
২। সুদের সাথে সম্পৃক্ত সকলেই অভিশপ্ত:
হযরত জাবির ইবনে আবদুলস্নাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সঃ) বলেন, সুদ গ্রহীতা, সুদ দাতা, সুদের চুক্তি লেখক এবং সুদী লেনদেনের স্বাক্ষীদ্বয়ের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন। তিনি বলেছেন পাপের দিক থেকে তারা সকলেই সমান অপরাধী।- (সহীহ মুসলিম)
৩। সুদের গুনাহ মায়ের সাথে জেনার চেয়েও মারাত্মক:
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সঃ) ইশরাদ করেছেন, \\\"সুদের মধ্যে সত্তর প্রকারের গুনাহ রয়েছে, এর মধ্যে সর্বনিম্ন গুনাহ হলো নিজের মায়ের সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়ার সমতুল্য।\\\"- (বায়হাকী ও ইবনে মাযাহ্)
৪। সুদের সামাজিক কুফলঃ
সুদ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার অনুভূতিকে নষ্ট করে চরম লোভ লালসা ও কৃপনতা সৃষ্টি করে।
৫। সুদী ব্যবসায় গরীব আরো গরীব এবং ধনী আরো ধনী হয়।
৬। সুদ মানব সম্পদকে কর্মবিমুখ করে।
৭। সুদের কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
আমাদের করণীয় : উত্তরণের পথ ইসলাম
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা যে বিপর্যস্ত একথা এখন সবাই স্বীকার করছে। তাহলে এর সমাধানে বিকল্প কি আছে? একটু ভেবে দেখা উচিৎ সুদ যে হারাম তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সুদ হারাম এতটুকু বলে দিলেই কি দায়িত্ব শেষ? না হারাম বলার সাথে সাথে বিকল্প হালাল কি ব্যবস্থা আছে তার পথ দেখিয়ে দিতে হবে। কারণ মহান আল্লাহ তা\\\'আলা হারামের পাশাপাশি হালালের রাস্ত্মা ও দেখিয়ে দিয়েছেন। যেমন- জেনা ব্যাভিচারের বিকল্প বিবাহ শাদীকে হালাল করেছেন। তেমনি সুদকে হারাম করার পাশাপাশি ব্যবসাকে হালাল করেছেন। এটাই মূলত ইসলামের শিক্ষা।
উদাহরণ স্বরূপ \\\"হযরত ইউসুফ (আঃ) এর কাছে বাদশাহ্র পক্ষ থেকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলার আগে স্বপ্নের মাধ্যমে যে বিপদের দিকে ইংগিত দেয়া হয়েছে তা থেকে মুক্তির পথ বলে দিয়েছেন\\\"- (সূরা ইউসুফ ৪৭)। এ আয়াত থেকে বুঝা গেল দায়ী শুধু হারামকে হারাম বা কোন বিপদের সংবাদ দিলেই দায়িত্ব শেষ হবে না বরং সাধ্যমত মুক্তির পথও দেখিয়ে দিতে হবে।
ইসলামে তিজারত বা ব্যবসা, ধনতান্ত্রিক ব্যবসা পদ্ধতি থেকে ভিন্নতর। নবী করীম (সঃ) বলেছেন,
التَّاجِرُ الأمينُ الصَّدُوقُ المُسْلِمُ: مع النَّبيِّينَ والصِّدِّيقين والشُّهداء
\"সৎ ব্যবসায়ীদের হাশর হবে নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সাথে\\\"। (জামিউল উসুল ফি আহাদীসির রাসূল স., ইবনে মাজাহ)
নবী করীম (সঃ) নিজে মুদারাবা পদ্ধতিতে হযরত খাদিজা (রাঃ) এর ব্যবসা দীর্ঘদিন সাফল্যের সাথে পরিচালনা করেছেন। ইসলামী বিধি বিধান না জানা থাকলে হয়তো সৎভাবে ব্যবসা করা যায়, কিন্তু তা সঠিক ইসলামী পদ্ধতি না ও হতে পারে।
আমাদের হানাফী মাযহাবের ইমাম নুমান ইবনে সাবিত আবু হানিফা (রহঃ) ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত বস্ত্র ব্যবসায়ী এবং বস্ত্র শিল্পপতি। কুফা, খোরাসান এবং মিশরে তার বস্ত্র কারখানা ছিল। আশারায়ে মুবাশ্বারা বা দুনিয়াতে বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন সাহাবীর মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) ব্যতীত বাকী ৯ জনই ছিলেন আরবের সেরা ব্যবসায়ী।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেতে বর্ণিত, তিনি বলেন রসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, \\\" একটি সময় এমন আসবে যখন সকল মানুষ সুদ খাবে। কেউ যদি সুদ নাও খায় তবু এর ধুলোবালি থেকে রক্ষা পাবেনা\\\" (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ।)
আমারা মনে করি সেই সময়টা হয়তো এখনই। কারণ, হয়ত এমন কোন শিল্প-কারখানা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যারা সুদী লেনদেনের সাথে জড়িত নয়, যাদের উৎপাদিত খাদ্য-দ্রব্য, জামা-কাপড়, জায়নামাজ, বাসা-বাড়ী ও মসজিদ নির্মানের উপকরণ, যানবাহন এক কথায় সকল জিনিষের ভিতরে সুদের সংমিশ্রন ঘটেনি। সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করার জন্য যে কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় করা নাজায়েজ, সে কোম্পানীর পণ্য -দ্রব্য ও হালাল হতে পারে না। অতএব, ভেবে দেখা উচিত আমদের কি করতে হবে? মেথরানীর হাতে তৈরী পরোটা, বেগুনভাজি, ভর্তা খেতে আমাদের অরুচি। কিন্তু পাশ্চাত্যে ও দেশের অভ্যন্তরে সুদখোর এজাতীয় খবিসদের তৈরী কোন জিনিস ব্যবহারে আমাদের আগ্রহের কমতি নেই।
অতএব, আমাদের ইসলামী অর্থনীতি কায়েমের চেষ্টাকে নামাজ রোজার মত ফরজ মনে করে চেষ্টা প্রচেষ্টা, আন্দোলন- কলমী, ও মৌখিক, জিহাদে অন্তত শরীক হতে হবে। জেনামুক্ত অর্থনীতি কায়েমের সাধনা করতে হবে। সুদী ব্যাংক, এনজিওগুলো মুসলমানদের প্রতি ঘরে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে সুদি ব্যাংকিং সেবা নিয়ে। আর আমরা মুসলমানরা শুধু সুদ হারাম! সুদ হারাম!! এতটুকু বলেই নিজেকে দায়মুক্ত মনে করে চুপিসরে ঘুমাচ্ছি।
এখন আমাদের কর্তব্য হবে পূর্নাঙ্গ ইসলামী অর্থব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে একটি পরিপূর্ণ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলমান ও অমুসলমানদেরকে সুদমুক্ত ব্যাংকিং সেবা দিয়ে ইসলামের সুমহান আদর্শের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। সুদ মুক্ত ব্যবসা করতে হলে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চিত অর্থ একত্রিত করতে হবে এবং সৎ ও দক্ষ উদ্যোক্তা তৈরী করতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সুদের মোকাবিলা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই করতে হবে।
এখন আমাদের সামনে দুটি পথই খোলা রয়েছে। হয় পৃথিবী সুদ, জুলুম, ভারসাম্যহীন অর্থনীতির যাতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে পাপাচারে ভরে যাক নতুবা সত্যিকার শান্তি ও কল্যাণময় পৃথিবীতে পরিণত হোক।
মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন:
إِنَّ اللَّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ
\" যে জাতি তার ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে না আল্লাহ তা\\\'আলাও তাদের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটিয়ে দেননা\"-সূরা র\'য়াদ: ১১
অতএব আসুন আমরা সবাই মিলে নিম্নোক্ত ধারাবাহিক কর্মসূচী বাস্ত্মবায়নের মাধ্যমে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়া ও আখিরাতের সম্বল সংগ্রহ করি।
কর্মসূচি
আমরা সবাই জানি ইসলাম নিছক কোন ধর্মের নাম নয়। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। যে ব্যবস্থার মধ্যে সু-স্পষ্ট অর্থব্যবস্থাও রয়েছে।
১। দ্বীনদার, পরহেজগার ও ওলামায়ে কেরামদের সমন্বয়ে একটি সোসাইটি গড়ে তুলতে হবে। এবং সোসাইটির সকল সদস্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চিত অর্থ একত্রিত করে মুদারাবা ও মুশারাকা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করে অর্জিত মুনাফা সঞ্চয়কারীদের মাঝে শরীয়াহ সম্মতভাবে বণ্টন করতে হবে।
২। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ও ওলামায়ে কেরামগণের মাঝে দূরত্ব কমিয়ে একদিকে আধুনিক নিত্য নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন অন্য দিকে ইসলামী অর্থব্যবস্থা সংক্রান্ত শরয়ী বিধান নিয়ে পর্যালোচনা করে ইসলামী অর্থব্যবস্থার মডেল উপস্থাপন করা।
৩। যেহেতু সুদী ব্যবস্থায় উৎপাদিত পণ্য-দ্রব্যের মধ্যে কোন না কোন অবস্থায় সুদের সংযোগ ঘটেই যায়। তাই সুদী ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদিত সকল পণ্য দ্রব্য পরিহার করে সোসাইটির উদ্যোক্তাদের দ্বারা হালাল উপায়ে উৎপাদিত পণ্য বিপণন ও ভোগ করতে হবে।
৪। সোসাইটির ফান্ড মজবুত হলে ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পুরো জাতিকে সুদের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করে ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক্ষেত্রে উলেস্নখ্য যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ গাইড লাইন অনুযায়ী পূর্নাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
৫। যাকাত, ওশর প্রভৃতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আদায় করে ইসলামের নির্দেশ মত বন্টনের উদ্যোগ নিতে হবে।
৬। ইসলামী উদ্যোক্তা তৈরী করার লক্ষ্যে আধুনিক ব্যবসা-বানিজ্য ও প্রযুক্তি এবং ইসলামী ব্যবসা পদ্ধতি সম্পর্কে নিয়মিত শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
আসুন আমরা সকলে মিলে সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা তথা ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রবর্তনের সর্বাত্বক আন্দোলনে নিজেকে আজই শরীক করি।
প্রবন্ধকার
এম ডি, পারফেক্ট বিজনেস এন্ড কমার্স লিমিটেড
১৭.০২.২০১২ ইং
+ comments + 1 comments
thak you very much,inportant news
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন