প্রতারণা করে এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ইন্টারনেটভিত্তিক আউট সোর্সিং প্রতিষ্ঠান ডোলেন্সারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রোকন ইউ আহমেদসহ তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পুলিশ। অন্যরা হলেন, ডোলেন্সারের পরিচালক (অর্থ) নজরুল ইসলাম ও চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান। তবে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে সস্ত্রীক সিঙ্গাপুর পালিয়েছেন ডোলেন্সারের এমডি। ডিজিটাল প্রতারণার ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির এমডিসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে ধানমণ্ডি থানায় দুটি মামলা হয়েছে। রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসে টাকা আয়ের লোভনীয় ফাঁদ পেতে ডোলেন্সার আউট সোর্সিং নামে একটি কোম্পানি অবৈধভাবে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করে। এরপরই মোটা অঙ্কের এ টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তাসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ পরিস্থিতিতে রাজধানীসহ সারাদেশে ডোলেন্সারের ৬৫ হাজার গ্রাহক চরম অনিশ্চয়তায় দিন পার করছেন।
ইন্টারনেটে ওয়েবসাইট লিজ নিয়ে ২০১১ সালের ১৯ জুন ক্লিক করেই টাকা আয়ের লোভনীয় ফাঁদ পাতে ডোলেন্সার। 'ক্লিক টু আর্ন'_ এমন প্যাকেজের মাধ্যমে বলা হয়েছিল, ৭ হাজার টাকা জমা দিয়ে হিসাবে নম্বর খোলা হলে প্রতিদিন ৭০ টাকা পাওয়া যাবে। ওয়েবসাইট লিজিং প্যাকেজে সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে পাওয়া যাবে দিনে ১৭৫ টাকা। এমন লোভনীয় ফাঁদে পড়েন হাজার হাজার বেকার তরুণ। প্রথমদিকে কিছুদিন ডোলেন্সার তাদের গ্রাহকদের কিছু টাকা পরিশোধ করে 'বিশ্বাস' অর্জনের চেষ্টা করে। এরপরই গ্রাহকদের সঙ্গে তাদের প্রতারণা শুরু হয়।
প্রতারণার শিকার আরিফ হোসেন সমকালকে বলেন, 'আমি ২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এক টাকাও ফেরত পাইনি। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ করে টাকা এনে ডোলেন্সারে বিনিয়োগ করি। টাকা ফেরত না পাওয়ায় চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। আশা করি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের টাকা ফেরত পেতে সহায়তা করবে। ডোলেন্সার নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ছিলেন রোকন ইউ আহমেদ, নজরুল ইসলাম ও নাজমুল হাসান। রোকন ছিলেন ডোলেন্সারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী। সম্প্রতি স্ত্রীকে নিয়ে সিঙ্গাপুর পালিয়ে গেছেন রোকন। তার অন্য দুই আত্মীয় ডোলেন্সারের পরিচালক (অর্থ) নজরুল ইসলাম ও চেয়ারম্যান নাজমুলও গা-ঢাকা দিয়েছেন।
প্রতারণার শিকার একাধিক ব্যক্তি ও ধানমণ্ডি থানার ওসি আনোয়ার হোসেন সমকালকে জানান, ধানমণ্ডির আলতা প্লাজায় ১০ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়িতে কার্যালয় খুলে ইন্টারনেটে প্রতারণা শুরু করে ডোলেন্সার। প্রতিদিন শত শত গ্রাহক ইন্টারনেটে হিসাব খুলে তাদের প্রতারণার জালে পা দেয়। পরে গ্রাহকদের টাকা না দিয়ে গা-ঢাকা দেন ডোলেন্সারের কর্তাব্যক্তিরা। এরপর গ্রাহকরা রাজধানীসহ সারাদেশে ডোলেন্সারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। এ ঘটনায় ধানমণ্ডি থানায় দুটি মামলা করা হয়েছে।
দৈনিক ১০০টি ওয়েবসাইটের লিংক দিয়ে থাকে ডোলেন্সার। সেই লিংকগুলোতে ক্লিক করতে হয়। প্রতিটি লিংকে ৩০ সেকেন্ড করে থাকতে হয়। প্রতি ক্লিকে এক সেন্ট আর ১০০ ক্লিকে এক ডলার। কোনো সদস্য নতুন সদস্য বানাতে পারলে ৫ শতাংশ কমিশন। অর্থাৎ সেই এমএলএম পদ্ধতি।
মামলা-গ্রেফতার : ডোলেন্সারের প্রতারণার ঘটনায় ধানমণ্ডি থানায় দায়ের করা মামলায় ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন_ রোকন ইউ আহমেদ, নজরুল ইসলাম, নাজমুল হাসান, রাজা মিয়া, শাকিল, আবদুল্লাহ আল মামুন, সাইমুম, খালেদ, রুশু, নূরে আলম সিদ্দিকী, শিবলু, রানা প্রমুখ। ধানমণ্ডি থানা পুলিশ এরই মধ্যে ডোলেন্সারের প্রতারণার ঘটনায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) নুরুল বশির নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। তিনি ডোলেন্সারে চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে কাজ করছিলেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধানমণ্ডি থানার পরিদর্শক অশোক কুমার চৌহান সমকালকে বলেন, অভিযুক্তদের গ্রেফতারে এরই মধ্যে একাধিক জায়গায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। ডোলেন্সারের তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যাতে বিদেশ পালিয়ে যেতে না পারে সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট একাধিক জায়গায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে আমাদের কাছে প্রাথমিক তথ্য রয়েছে, চিঠি দেওয়ার আগেই ডোলেন্সারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার স্ত্রীসহ সিঙ্গাপুর পালিয়ে গেছে। ডোলেন্সারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার প্রক্রিয়া আমরা শুরু করব।
বর্তমানে বাংলাদেশে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান হলো_ ব্রাভো আইটি, ল্যান্সটেক, অনলাইন অ্যাড ক্লিক, পেইড টু ক্লিক, সেফটি ক্লিক, স্কাইলেন্সার, পিটিসি ফর বিডি, অ্যাড সোর্সিং, ক্লিক টু পেইডসহ অন্তত ৩০টি প্রতিষ্ঠান। নিজেদের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যবসা করছে এসব প্রতিষ্ঠান, যাদের বেশির ভাগেরই নেই কোনো প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি বা অফিস।
এ ব্যাপারে ডোলেন্সারের একাধিক কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। ডোলেন্সারের ধানমন্ডি ও কলাবাগান কার্যালয়ও বন্ধ পাওয়া গেছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন